জাপান থেকে অকশনের গাড়ি কেনার নিয়ম ও খরচ – কমপ্লিট গাইড ২০২৫
জাপান থেকে অকশনের গাড়ি কেনার নিয়ম ও খরচ – কমপ্লিট গাইড ২০২৫
- ভূমিকা
- জাপানিজ কার অকশন আসলে কী?
- কেন শোরুমের চেয়ে অকশন থেকে কেনা ভালো?
- অকশনের গাড়ি কেনার ধাপসমূহ (Step-by-Step)
- সঠিক ভেন্ডর বা ব্রোকার নির্বাচন
- অকশন শিট চেনার উপায় ও গ্রেড মিনিং
- বিডিং প্রসেস: কীভাবে বিড করবেন?
- জাপান থেকে গাড়ি আনার খরচ (Cost Breakdown)
- পেমেন্ট মেথড ও এলসি (LC) খোলার নিয়ম
- শিপিং এবং পোর্ট ক্লিয়ারিং প্রসেস
- অকশনের নামে প্রতারণা ও বাঁচার উপায়
- প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
- অনলাইনে অকশন শিট যাচাই করার নিয়ম
- গাড়ি হাতে পাওয়ার পর রেজিস্ট্রেশন
- উপসংহার
- প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs)
গাড়ি কেনা প্রত্যেকটি মধ্যবিত্ত বাংলাদেশির জন্য একটি স্বপ্নের মতো। আমরা যারা কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে জীবনের প্রথম গাড়িটি কিনতে যাই, তাদের মনে সবসময় একটি ভয় কাজ করে—আমি কি ঠকে যাচ্ছি? গাড়িটি কি সত্যিই ভালো? শো-রুমে চকচকে যে গাড়িটি দেখছি, তার ভেতরে কি কোনো সমস্যা লুকিয়ে আছে? এই দ্বিধা দূর করার একমাত্র উপায় হলো অকশনের গাড়ি কেনার নিয়ম সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা। ২০২৫ সালে এসে তথ্যের অবাধ প্রবাহের যুগে আপনি যদি না জেনে গাড়ি কিনেন, তবে সেটা হবে আপনার বোকামি। আজকের এই ব্লগে আমি আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আপনাদের জানাব কীভাবে সরাসরি জাপান থেকে অকশনের মাধ্যমে গাড়ি কেনা যায় এবং এর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো কী কী।
অনেকে মনে করেন, জাপান থেকে সরাসরি গাড়ি আনা অনেক ঝামেলার কাজ। কিন্তু সঠিক গাইডলাইন এবং একজন বিশ্বস্ত এজেন্টের সহায়তায় এটি শো-রুম থেকে গাড়ি কেনার চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ এবং সাশ্রয়ী হতে পারে, আপনি যখন Buying auction car from Japan to Bangladesh প্রসেসটি বুঝবেন, তখন আপনি নিজেই গাড়ির আসল ইতিহাস, মাইলেজ এবং কন্ডিশন যাচাই করতে পারবেন। এই আর্টিকেলে আমরা অকশন শিট রিডিং থেকে শুরু করে পোর্টে গাড়ি রিলিজ করা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করব, যাতে আপনি আত্মবিশ্বাসের সাথে আপনার স্বপ্নের গাড়িটি ঘরে তুলতে পারেন।
জাপানিজ কার অকশন আসলে কী?
জাপানিজ কার অকশন হলো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এবং সুশৃঙ্খল গাড়ির বাজার। জাপানে ট্রাফিক আইন এবং পরিবেশ রক্ষা আইন অত্যন্ত কঠোর হওয়ার কারণে, সেখানকার মানুষ সাধারণত ৩ থেকে ৫ বছর ব্যবহারের পর গাড়ি বিক্রি করে দেয়। এই ব্যবহৃত গাড়িগুলো তখন বিভিন্ন অকশন হাউজে (যেমন USS, TAA, ARAI, JU) তোলা হয়। সেখানে হাজার হাজার ডিলার এবং এক্সপোর্টার বিডিংয়ের মাধ্যমে এই গাড়িগুলো কিনে নেন। এই পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দ্রুত এবং স্বচ্ছ। একটি গাড়ি বিডিংয়ের জন্য স্ক্রিনে আসার পর মাত্র ১০ থেকে ২০ সেকেন্ডের মধ্যে তা বিক্রি হয়ে যায়।
এই অকশনগুলো সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত নয়; অর্থাৎ আপনি চাইলেই সরাসরি সেখানে গিয়ে বিড করতে পারবেন না। এর জন্য প্রয়োজন হয় মেম্বারশিপ। বাংলাদেশে যারা রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ব্যবসা করেন বা যারা ইনডেন্টর (Indentor) হিসেবে কাজ করেন, তাদের এই অকশন হাউজগুলোর অ্যাক্সেস থাকে। তারা আপনার হয়ে বিড করে এবং গাড়িটি কিনে বাংলাদেশে ইমপোর্ট করে দেয়। তাই অকশনের গাড়ি কেনার নিয়ম এর প্রথম শর্তই হলো এই সিস্টেমটি কীভাবে কাজ করে তা বোঝা এবং এটি কোনো রিটেইল শপ নয়, বরং একটি হোলসেল মার্কেটপ্লেস।
কেন শোরুমের চেয়ে অকশন থেকে কেনা ভালো?
সরাসরি অকশন থেকে গাড়ি কেনার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো 'স্বচ্ছতা' বা Transparency। আপনি যখন শো-রুম থেকে গাড়ি কেনেন, তখন অনেক সময় গাড়ির আসল ইতিহাস জানা সম্ভব হয় না। অসাধু ব্যবসায়ীরা জাপানে এক্সসিডেন্ট করা বা 'R' গ্রেডের গাড়ি কম দামে কিনে এনে মেরামত করে এবং মিটার টেম্পারিং করে (মাইলেজ কমিয়ে) নতুনের মতো সাজিয়ে বিক্রি করে। কিন্তু আপনি যখন অকশন থেকে কিনবেন, তখন আপনি গাড়ির 'অকশন শিট' বা রিপোর্ট কার্ড নিজের চোখে দেখতে পাবেন। সেখানে গাড়ির প্রতিটি দাগ, স্ক্র্যাচ এবং ইঞ্জিনের অবস্থার বিবরণ থাকে।
দ্বিতীয় সুবিধাটি হলো 'খরচ সাশ্রয়'। শো-রুমে গাড়িটি সাজিয়ে রাখতে তাদের অনেক খরচ হয়—শো-রুম ভাড়া, স্টাফ বেতন, ব্যাংক লোন ইন্টারেস্ট ইত্যাদি। এই সব খরচ গাড়ির দামের সাথে যুক্ত হয়। কিন্তু আপনি যদি প্রি-অর্ডার করে বা সরাসরি অকশন থেকে গাড়ি আনান, তবে এই মধ্যবর্তী খরচগুলো বেঁচে যায়। জাপান থেকে গাড়ি আনার খরচ হিসাব করলে দেখা যায়, সরাসরি আনলে অনেক ক্ষেত্রে ১ থেকে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সাশ্রয় করা সম্ভব। এছাড়া নিজের পছন্দমতো কালার এবং অপশন বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা তো থাকছেই।
অকশনের গাড়ি কেনার ধাপসমূহ (Step-by-Step)
অকশন থেকে গাড়ি কেনার প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথমেই আপনাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে যে, গাড়িটি হাতে পেতে আপনার দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগতে পারে। প্রথম ধাপ হলো আপনার বাজেট এবং পছন্দের মডেল ঠিক করা। এরপর আপনাকে একজন বিশ্বস্ত ইমপোর্টার বা এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। তাদের সাথে চুক্তি করার পর তারা আপনাকে বিভিন্ন অকশন সাইটের অ্যাক্সেস দেবে বা প্রতিদিনের এভেইলেবল গাড়ির তালিকা পাঠাবে।
দ্বিতীয় ধাপে, আপনি আপনার পছন্দের গাড়িটি সিলেক্ট করবেন এবং এজেন্টকে বিড করার নির্দেশ দেবেন। বিড করার আগে অবশ্যই অকশন শিটটি ভালো করে যাচাই করে নেবেন। যদি আপনার বিড জিতে যায় (Win), তবে আপনাকে গাড়ির মূল দাম (FOB Price) জাপানে পাঠাতে হবে। এরপর শিপমেন্টের প্রসেস শুরু হবে। গাড়ি বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর কাস্টমস ডিউটি এবং অন্যান্য ট্যাক্স পরিশোধ করে গাড়িটি খালাস করতে হবে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় এজেন্টের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই সঠিক মানুষ নির্বাচন করাটাই আসল কাজ।
সঠিক ভেন্ডর বা ব্রোকার নির্বাচন
যেহেতু আপনি নিজে সরাসরি জাপানি অকশনে বিড করতে পারবেন না, তাই একজন মধ্যস্থতাকারী বা ব্রোকার প্রয়োজন। বাংলাদেশে এখন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা 'অকশন পারচেজ' বা 'প্রি-অর্ডার' সার্ভিস দেয়। এদের মধ্যে ভালো-মন্দ যাচাই করা জরুরি। প্রথমেই দেখুন তাদের নিজস্ব শো-রুম বা অফিস আছে কিনা এবং তারা বারবিডা (BARVIDA) এর সদস্য কিনা। তাদের পূর্বের কাজের রেকর্ড দেখুন এবং সম্ভব হলে তাদের মাধ্যমে আগে যারা গাড়ি এনেছে তাদের সাথে কথা বলুন।
একজন ভালো ব্রোকার বা ভেন্ডর আপনাকে কখনো অন্ধের মতো গাড়ি কিনতে বলবে না। তারা আপনাকে Japan car auction sheet verification BD এর মাধ্যমে গাড়ির আসল অবস্থা বুঝিয়ে দেবে এবং সম্ভাব্য খরচ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দেবে। অনেক সময় ভুয়া ব্রোকাররা কম বাজেট দেখিয়ে টাকা নিয়ে পরে গায়েব হয়ে যায় অথবা খারাপ গাড়ি গছিয়ে দেয়। তাই ব্রোকার নির্বাচনের সময় কোনো প্রকার তাড়াহুড়ো করবেন না এবং সমস্ত লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে করার চেষ্টা করবেন।
অকশন শিট চেনার উপায় ও গ্রেড মিনিং
অকশন শিট হলো গাড়ির জন্মসনদ বা রেজাল্ট কার্ড। এটি পড়তে জানাটা গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। অকশন শিটে গাড়ির কন্ডিশনকে বিভিন্ন গ্রেডে ভাগ করা হয়। যেমন— Grade S বা 6 মানে প্রায় নতুন গাড়ি। Grade 5 মানে চমৎকার কন্ডিশন, খুব কম চলেছে। Grade 4.5 মানে খুব ভালো কন্ডিশন, সামান্য কিছু স্ক্র্যাচ থাকতে পারে। Grade 4 মানে ভালো কন্ডিশন, তবে কিছু ডেন্ট বা দাগ আছে যা পলিশ করলে ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের দেশের জন্য গ্রেড ৪ বা ৪.৫ হলো আদর্শ।
অন্যদিকে, Auction grade meaning in Bengali জানতে হলে আপনাকে খারাপ গ্রেডগুলোও চিনতে হবে। Grade R বা RA মানে গাড়িটি কোনো একসিডেন্টের শিকার হয়েছিল এবং পরে মেরামত করা হয়েছে। Grade 3.5 বা 3 মানে গাড়িতে অনেক স্ক্র্যাচ, ডেন্ট বা জং আছে। এছাড়া ইন্টেরিয়র গ্রেডও থাকে, যেমন A (খুব ভালো), B (ভালো), C (নোংরা বা পোড়া দাগ আছে)। গাড়ি কেনার সময় অবশ্যই গ্রেড ৪ এর নিচে নামা উচিত নয় এবং ইন্টেরিয়র গ্রেড B এর উপরে থাকা ভালো। অকশন শিটের ম্যাপে 'XX' চিহ্ন থাকলে বুঝবেন সেই অংশটি পরিবর্তন করা হয়েছে।
বিডিং প্রসেস: কীভাবে বিড করবেন?
বিডিং প্রক্রিয়াটি অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ । আপনার সিলেক্ট করা গাড়িটি যখন অকশনে লাইভ হয়, তখন আপনার এজেন্ট জাপানে বসে বিড বাটনে চাপ দেন। বিডিং শুরু হওয়ার আগে আপনাকে একটি সর্বোচ্চ সীমা (Max Bid) ঠিক করে দিতে হবে। ধরুন, আপনি একটি টয়োটা প্রিমিওর জন্য ১৫ লক্ষ ইয়েন বাজেট দিলেন। যদি বিডিং ১৪ লক্ষে শেষ হয়, তবে আপনি গাড়িটি পেয়ে যাবেন। আর যদি দাম ১৫ লক্ষ পার হয়ে যায়, তবে এজেন্ট বিড করা বন্ধ করে দেবেন।
মনে রাখবেন, বিড জেতার পর আর পিছিয়ে আসার সুযোগ নেই। যদি আপনি গাড়িটি জেতার পর টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান, তবে অকশন হাউজ আপনার এজেন্টকে বড় অঙ্কের জরিমানা করবে এবং তার মেম্বারশিপ বাতিলও করতে পারে। তাই বিড করার আগে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে নিন। অনেক সময় 'Unsold' গাড়িগুলোও পরে নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে কেনা যায়, যাকে বলা হয় 'One Price' বা 'Negotiation Purchase'। আপনার এজেন্ট এই অপশনগুলো সম্পর্কে আপনাকে গাইড করবেন।
জাপান থেকে গাড়ি আনার খরচ (Cost Breakdown)
অনেকেই জানতে চান জাপান থেকে গাড়ি আনার খরচ আসলে কত? খরচের হিসাবটা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমত, FOB Price (Free On Board) বা গাড়ির কেনা দাম। এর সাথে যুক্ত হয় অকশন হাউজ ফি, জাপানের লোকাল ট্রান্সপোর্ট খরচ এবং এজেন্টের কমিশন। দ্বিতীয়ত, Freight Charge বা জাহাজ ভাড়া, যা গাড়িটি জাপান থেকে বাংলাদেশের পোর্টে আনতে খরচ হয়। এই দুটি মিলিয়ে হয় C&F (Cost and Freight) ভ্যালু।
তৃতীয় এবং সবচেয়ে বড় অংশটি হলো Custom Duty & Taxes। বাংলাদেশে গাড়ির সিসি (CC) এবং টাইপের (হাইব্রিড/নন-হাইব্রিড) ওপর ভিত্তি করে ট্যাক্স নির্ধারিত হয়। যেমন, ১৫০০ সিসির একটি গাড়ির জন্য এক রকম ট্যাক্স, আবার ২০০০ সিসির জন্য অন্য রকম। এর বাইরে পোর্ট চার্জ, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের কমিশন, এবং বিআরটিএ রেজিস্ট্রেশন ফি যুক্ত হবে। সব মিলিয়ে গাড়ির অকশন প্রাইসের সাথে এই অতিরিক্ত খরচগুলো যোগ করেই চূড়ান্ত দাম বের করতে হয়। তাই শুধু জাপানের ইয়েন প্রাইস দেখে খুশি হবেন না, ট্যাক্স ক্যালকুলেশনটা ভালো করে বুঝে নিন।
| খরচের খাত | বিবরণ | আনুমানিক পরিমাণ (উদাহরণ) |
|---|---|---|
| Car Price | অকশনে জেতা দাম | ১৫,০০,০০০ ইয়েন |
| FOB Charges | অকশন ফি, ট্রান্সপোর্ট, এজেন্ট কমিশন | ১,০০,০০০ - ১,৫০,০০০ ইয়েন |
| Freight | জাহাজ ভাড়া (জাপান টু চট্টগ্রাম/মোংলা) | $১২০০ - $১৫০০ ডলার |
| Custom Duty | সরকারি শুল্ক (সিসি ভেদে ভিন্ন) | সিসি অনুযায়ী নির্ধারিত (যেমন ১৫০০ সিসিতে প্রায় ১২৭%) |
| Port & Others | পোর্ট চার্জ, ব্যাংক চার্জ, লোকাল এজেন্ট | ৫০,০০০ - ৮০,০০০ টাকা |
পেমেন্ট মেথড ও এলসি (LC) খোলার নিয়ম
গাড়ির দাম পরিশোধ করার বৈধ এবং নিরাপদ উপায় হলো ব্যাংকিং চ্যানেল বা এলসি (Letter of Credit)। আপনি যখন গাড়িটি নিশ্চিত করবেন, তখন আপনার এজেন্ট আপনাকে একটি ইনভয়েস দেবে। এই ইনভয়েসের বিপরীতে আপনাকে ব্যাংকে গিয়ে এলসি খুলতে হবে। এলসির মাধ্যমে টাকা পাঠালে আপনার কাছে প্রমাণ থাকবে এবং জালিয়াতির সুযোগ কমে যাবে। তবে ছোট অঙ্কের বা কম দামের গাড়ির ক্ষেত্রে অনেকে টিটি (Telegraphic Transfer) এর মাধ্যমেও টাকা পাঠান।
বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা কিছুটা সময়সাপেক্ষ হতে পারে। তাই গাড়ি কেনার আগে আপনার ব্যাংকের সাথে কথা বলে নিন। আপনি চাইলে পুরো টাকা একসাথে না দিয়ে ধাপে ধাপে দিতে পারেন—প্রথমে বুকিং মানি, তারপর এলসি খোলার সময় মার্জিন, এবং শেষে ডিউটি ও ট্যাক্সের টাকা। মনে রাখবেন, গাড়ির ডিউটি বা শুল্ক পরিশোধ করার সময় অবশ্যই পে-অর্ডার বা ব্যাংক ড্রাফট ব্যবহার করবেন, নগদ লেনদেন এড়িয়ে চলাই ভালো।
শিপিং এবং পোর্ট ক্লিয়ারিং প্রসেস
জাপানে পেমেন্ট নিশ্চিত হওয়ার পর সাপ্লায়ার গাড়িটি শিপিংয়ের জন্য বুকিং দেবেন। জাপান থেকে জাহাজ ছেড়ে চট্টগ্রাম বা মোংলা পোর্টে আসতে সাধারণত ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগে। জাহাজ ছাড়ার পর আপনি বিএল (Bill of Lading) কপি পাবেন, যা গাড়ির মালিকানার দলিল হিসেবে কাজ করে। এই কাগজটি যত্ন করে রাখতে হবে কারণ এটি ছাড়া পোর্ট থেকে গাড়ি খালাস করা যাবে না।
গাড়ি পোর্টে পৌঁছানোর পর কাস্টমস ক্লিয়ারিং বা খালাস প্রক্রিয়া শুরু হয়। এখানে একজন অভিজ্ঞ সিঅ্যান্ডএফ (C&F) এজেন্ট নিয়োগ করা জরুরি। তিনি কাস্টমসে গাড়ির অ্যাসেসমেন্ট করাবেন, ট্যাক্স জমা দেবেন এবং যাবতীয় পেপারওয়ার্ক শেষ করে গেট পাস সংগ্রহ করবেন। এই ধাপে ২ থেকে ৫ দিন সময় লাগতে পারে। পোর্ট থেকে গাড়ি বের করার সময় গাড়ির ব্যাটারি, টুলস বা লোগো চুরি হয়েছে কিনা তা চেক করে নেবেন, কারণ পোর্টে চুরির ঘটনা মাঝেমধ্যে ঘটে।
অকশনের নামে প্রতারণা ও বাঁচার উপায়
অকশনের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণাও কম হয় না। সবচেয়ে বড় প্রতারণা হলো 'ফটোশপ করা অকশন শিট'। অসাধু ব্যবসায়ীরা 'R' গ্রেডের শিট এডিট করে '4' গ্রেড বানিয়ে দেখায়। আবার অনেকে কম মাইলেজ দেখানোর জন্য শিটের মাইলেজ সংখ্যা পরিবর্তন করে। আরেকটি প্রতারণা হলো—গ্রাহকের কাছ থেকে ভালো গাড়ির টাকা নিয়ে পরে নিম্নমানের গাড়ি পাঠানো।
এসব থেকে বাঁচার উপায় হলো—নিজে যাচাই করা। কখনোই এজেন্টের দেওয়া শিটের ওপর ১০০% ভরসা করবেন না। অনলাইনে বেশ কিছু পেইড ওয়েবসাইট আছে (যেমন aleado, carvx) যেখানে চেসিস নম্বর দিয়ে সার্চ দিলে আসল অকশন শিট এবং ছবি পাওয়া যায়। এতে ৫-১০ ডলার খরচ হতে পারে, কিন্তু লাখ টাকার গাড়ির সুরক্ষায় এটি কিছুই না। এছাড়া, গাড়ির চেসিস নম্বরের সাথে অকশন শিটের চেসিস নম্বর মিলছে কিনা তা অবশ্যই চেক করবেন।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
জাপান থেকে গাড়ি আমদানি করতে এবং কাস্টমস থেকে ছাড়াতে আপনার কিছু ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাগজের প্রয়োজন হবে। ব্যক্তিগত আমদানির ক্ষেত্রে আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) এবং হালনাগাদ ই-টিন (E-TIN) সার্টিফিকেট লাগবে। আপনার টিন সার্টিফিকেটে আয়কর রিটার্ন দেওয়া আছে কিনা তা কাস্টমস চেক করতে পারে।
এছাড়া এলসি খোলার জন্য ব্যাংক সচ্ছলতার প্রমাণপত্র বা ব্যাংক স্টেটমেন্ট লাগতে পারে। গাড়ি খালাস করার সময় বিল অফ লেডিং (BL), কমার্শিয়াল ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট, এবং অকশন শিটের অরিজিনাল কপি প্রয়োজন হবে। আপনার সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আপনাকে এই কাগজপত্রের তালিকা দেবে। আগে থেকেই এই কাগজগুলো প্রস্তুত রাখলে পোর্টে অযথা দেরি বা ডেমারেজ চার্জ থেকে বাঁচা যায়।
অনলাইনে অকশন শিট যাচাই করার নিয়ম
Japan car auction sheet verification BD এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ। বেশ কিছু বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট আছে যারা সামান্য ফি এর বিনিময়ে আপনাকে অকশনের আসল তথ্য সরবরাহ করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— Aleado, CarVX, Japanese Car Trade ইত্যাদি। আপনাকে শুধু গাড়ির চেসিস নম্বরটি (Chassis Number) সংগ্রহ করতে হবে।
চেসিস নম্বর দিয়ে সার্চ দিলে আপনি গাড়ির অকশনের তারিখ, লট নম্বর, আসল মাইলেজ, গ্রেড এবং অকশনের সময় তোলা ছবিগুলো দেখতে পাবেন। যদি দেখেন এজেন্টের দেওয়া শিটের সাথে অনলাইনের তথ্যের অমিল আছে (যেমন মাইলেজ কম-বেশি বা গ্রেড ভিন্ন), তবে বুঝবেন সেখানে ঘাপলা আছে। মনে রাখবেন, ফ্রি-তে এখন আর অথেনটিক অকশন শিট পাওয়া খুব কঠিন, তাই পেইড সার্ভিস ব্যবহার করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
গাড়ি হাতে পাওয়ার পর রেজিস্ট্রেশন
গাড়ি পোর্ট থেকে খালাস করে আনার পর আপনার কাজ শেষ নয়। এবার বিআরটিএ (BRTA) থেকে রেজিস্ট্রেশন করানোর পালা। গাড়িটি রাস্তায় চালানোর জন্য রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন এবং ডিজিটাল নম্বর প্লেট বাধ্যতামূলক। আমদানিকৃত গাড়ির ক্ষেত্রে কাস্টমস থেকে পাওয়া 'বিল অফ এন্ট্রি' এবং অন্যান্য ছাড়পত্রের কপি বিআরটিএ-তে জমা দিতে হয়।
সাধারণত শো-রুম বা ইমপোর্টাররাই রেজিস্ট্রেশনের কাজ করে দেয়। তবে আপনি নিজেও বিআরটিএ অফিসে গিয়ে আবেদন করতে পারেন। রেজিস্ট্রেশন ফি নির্ভর করে গাড়ির সিসির ওপর। রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলে আপনি ডিজিটাল ব্লু-বুক এবং স্মার্ট কার্ড পাবেন। মনে রাখবেন, অস্থায়ী রেজিস্ট্রেশন বা 'অন টেস্ট' দিয়ে বেশিদিন গাড়ি চালানো ঠিক নয়, এতে আইনি ঝামেলা হতে পারে।
উপসংহার: চূড়ান্ত পরামর্শ
পরিশেষে বলা যায়, জাপান থেকে অকশনের গাড়ি কেনার নিয়ম ও খরচ সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকলে আপনি কখনোই ঠকবেন না। এটি একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া হতে পারে, কিন্তু দিনশেষে আপনি এমন একটি গাড়ি পাবেন যার ইতিহাস স্বচ্ছ এবং পারফরম্যান্স নতুনের মতোই। দালালের মিষ্টি কথায় না ভুলে, নিজের বিচার-বুদ্ধি এবং প্রযুক্তির সাহায্য নিন।
আমার পরামর্শ হলো, খুব বেশি সস্তা খুঁজতে যাবেন না। ভালো জিনিসের দাম একটু বেশিই হয়। গ্রেড ৪ বা ৪.৫ এর নিচে নামবেন না এবং অবশ্যই অনলাইন ভেরিফিকেশন করবেন। আশা করি এই গাইডটি আপনার স্বপ্নের গাড়ি কেনার যাত্রাকে সহজ ও নিরাপদ করবে। শুভকামনা আপনার এবং আপনার নতুন গাড়ির জন্য!
- স্বচ্ছতা: অকশন শিট হলো গাড়ির আসল আয়না, এটি পড়তে শিখুন।
- গ্রেড: গ্রেড ৪ বা ৪.৫ এবং ইন্টেরিয়র B এর গাড়ি কিনুন।
- যাচাই: চেসিস নম্বর দিয়ে অনলাইনে শিট ভেরিফাই করা বাধ্যতামূলক।
- খরচ: শুধু গাড়ির দাম নয়, ডিউটি এবং শিপিং চার্জ আগেই হিসাব করুন।
সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
না, সাধারণ ব্যক্তি হিসেবে আপনি সরাসরি জাপানি কার অকশন (যেমন USS, TAA) এ অংশগ্রহণ বা বিড করতে পারবেন না। এই অকশনগুলো শুধুমাত্র রেজিস্টার্ড মেম্বার, ডিলার এবং এক্সপোর্টারদের জন্য উন্মুক্ত। সেখানে বিড করতে হলে মেম্বারশিপ এবং সিকিউরিটি ডিপোজিট প্রয়োজন হয়। তবে আপনি বাংলাদেশ থেকে একজন রেজিস্টার্ড এজেন্ট বা ব্রোকারের মাধ্যমে আপনার পছন্দের গাড়িতে বিড করতে পারেন। এজেন্ট আপনার হয়ে বিডিং প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে এবং গাড়ি জেতার পর শিপিংয়ের ব্যবস্থা করবে।
'R' গ্রেড (Repaired) মানে হলো গাড়িটি অতীতে কোনো একসিডেন্টের শিকার হয়েছিল এবং পরে মেরামত করা হয়েছে। বাজেটের দিক থেকে এগুলো অনেক সস্তা হয়। যদি মেরামতটি খুব মাইনর হয় (যেমন বাম্পার বা ফেন্ডার চেঞ্জ), তবে অভিজ্ঞ মেকানিক দিয়ে চেক করিয়ে কেনা যেতে পারে। কিন্তু যদি চেসিস বা ফ্রেমে ড্যামেজ থাকে, তবে সেই গাড়ি কেনা উচিত নয় কারণ এতে দীর্ঘমেয়াদে অ্যালাইনমেন্ট বা সেফটি ইস্যু হতে পারে। সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য গ্রেড ৪ বা ৪.৫ কেনাই সবচেয়ে নিরাপদ।
পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে সাধারণত দেড় থেকে দুই মাস বা ৪৫-৬০ দিন সময় লাগে। অকশনে গাড়ি জেতার পর পেমেন্ট এবং শিপিং বুকিং করতে ১-২ সপ্তাহ লাগে। জাপান থেকে জাহাজ ছেড়ে চট্টগ্রাম বা মোংলা পোর্টে পৌঁছাতে প্রায় ২০-২৫ দিন সময় নেয়। এরপর পোর্টে কাস্টমস ক্লিয়ারিং, ডিউটি পেমেন্ট এবং আনুষাঙ্গিক কাগজপত্রের কাজ শেষ করতে আরও ৩-৭ দিন লাগতে পারে। তবে আবহাওয়া বা জাহাজের শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে এই সময় কিছুটা কম-বেশি হতে পারে।
বর্তমানে অনলাইনে অকশন শিট যাচাই করার জন্য বেশ কিছু জনপ্রিয় এবং বিশ্বাসযোগ্য ওয়েবসাইট রয়েছে। এর মধ্যে 'Aleado', 'CarVX', এবং 'Japanese Car Trade' অন্যতম। এই সাইটগুলোতে গাড়ির চেসিস নম্বর (Chassis Number) দিয়ে সার্চ দিলে আপনি গাড়ির অকশন হিস্ট্রি, আসল অকশন শিট এবং ছবি দেখতে পাবেন। এই সেবাগুলো সাধারণত পেইড হয় (৫০০ থেকে ১০০০ টাকা বা সমপরিমাণ ডলার), তবে লক্ষ টাকার গাড়ির সুরক্ষায় এটি অত্যন্ত জরুরি একটি পদক্ষেপ।
নিয়ম বা প্রক্রিয়ার দিক থেকে হাইব্রিড এবং নন-হাইব্রিড গাড়ির আমদানি একই। তবে শুল্কায়ন বা কাস্টমস ডিউটির ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার পরিবেশবান্ধব গাড়ি উৎসাহিত করতে হাইব্রিড গাড়ির ওপর শুল্ক কিছুটা কম নির্ধারণ করেছে। সিসি ভেদে হাইব্রিড গাড়ির ডিউটি নন-হাইব্রিডের তুলনায় কম হয়, যার ফলে চূড়ান্ত খরচ কিছুটা কমে আসে। অকশন থেকে হাইব্রিড গাড়ি কেনার সময় ব্যাটারির কন্ডিশন এবং মাইলেজ খুব সতর্কতার সাথে যাচাই করা উচিত।