বাংলাদেশে গাড়ির দাম বেশি কেন? উচ্চ দামের পেছনের আসল কারণগুলো জানুন
বাংলাদেশে গাড়ির দাম বেশি কেন? উচ্চ দামের পেছনের আসল কারণগুলো জানুন
আমি যখন প্রথমবার একটি গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তখন শোরুমে গিয়ে দাম শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। যে গাড়িটি জাপানে বা ভারতে খুব সাধারণ দামে বিক্রি হচ্ছে, সেই একই গাড়ি বাংলাদেশে কিনতে গেলে আমাদের দ্বিগুণ বা তারও বেশি টাকা গুনতে হয়। আমি নিশ্চিত, আমার মতো আপনার মনেও এই প্রশ্নটি বারবার এসেছে—আসলে বাংলাদেশে গাড়ির দাম বেশি কেন? এটি কি শুধুই ব্যবসায়ীদের মুনাফা, নাকি এর পেছনে গভীর কোনো অর্থনৈতিক কারণ আছে?
গাড়ি এখন আর বিলাসিতা নয়, অনেকের জন্যই এটি একটি প্রয়োজনীয় জিনিস। কিন্তু আমাদের দেশে মধ্যবিত্তের জন্য একটি ভালো মানের গাড়ি কেনা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। এই আর্টিকেলে আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরব গাড়ির দাম বেশি বাংলাদেশ হওয়ার পেছনের মূল কারণগুলো। শুল্ক কাঠামো থেকে শুরু করে ডলার সংকট, এবং রেজিস্ট্রেশন খরচ—সবকিছুই আমরা খুটিনাটি আলোচনা করব। চলুন, গভীরে গিয়ে জেনে নিই কেন আমাদের পকেট থেকে এত টাকা বেরিয়ে যায়।

সূচিপত্র
- ১. বাংলাদেশে গাড়ির উচ্চ শুল্ক ও কর কাঠামো
- ২. গাড়ির ট্যাক্স ক্যালকুলেশন: একটি বাস্তব উদাহরণ
- ৩. রিকন্ডিশন্ড বনাম নতুন গাড়ির দামের পার্থক্য
- ৪. ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও আমদানি খরচ
- ৫. সিসি (Engine CC) ভেদে করের তারতম্য
- ৬. অবকাঠামো ও রেজিস্ট্রেশন খরচের প্রভাব
- ৭. ডিলারদের মুনাফা ও শোরুমের খরচ
- ৮. স্থানীয় উৎপাদনের অভাব
- ৯. ভারত ও প্রতিবেশী দেশের সাথে তুলনা
- ১০. হাইব্রিড ও ইলেকট্রিক গাড়ির বর্তমান অবস্থা
- ১১. গাড়ি কেনার আগে কিছু জরুরি পরামর্শ
- সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)
- উপসংহার
১. বাংলাদেশে গাড়ির উচ্চ শুল্ক ও কর কাঠামো
আপনি যদি এক কথায় জানতে চান যে বাংলাদেশে গাড়ির দাম বেশি কেন, তবে তার সবচেয়ে বড় উত্তর হলো সরকারের শুল্ক নীতি। আমাদের দেশে গাড়িকে এখনো একটি 'বিলাসী পণ্য' হিসেবে গণ্য করা হয়, কোনো প্রয়োজনীয় বাহন হিসেবে নয়। তাই সরকার এই খাত থেকে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা করে। যখন একটি গাড়ি চট্টগ্রাম বা মোংলা বন্দরে এসে পৌঁছায়, তখন তার মূল দামের ওপর বিভিন্ন স্তরে কর আরোপ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে কাস্টমস ডিউটি, রেগুলেটরি ডিউটি, ভ্যাট এবং সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি। এই করের পরিমাণ এতটাই বেশি যে, অনেক সময় গাড়ির মূল দামের চেয়ে করের পরিমাণ বেশি হয়ে যায়।
শুধু তাই নয়, গাড়ির শুল্ক ও কর বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। আমি দেখেছি, একটি সাধারণ ১৫০০ সিসির গাড়ির জন্য আপনাকে প্রায় ১২৭% থেকে শুরু করে ১৫০% পর্যন্ত কর দিতে হতে পারে। আর যদি গাড়ির সিসি বেশি হয়, তবে তো কথাই নেই; করের পরিমাণ ৮০০% পর্যন্তও পৌঁছাতে পারে। এই বিশাল শুল্কের বোঝা শেষ পর্যন্ত ক্রেতাকেই বহন করতে হয়। ফলে জাপানে যে গাড়িটি ৫ লাখ টাকায় বিক্রি হয়, সেটি বাংলাদেশে রাস্তায় নামাতে নামাতে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা হয়ে যায়। এটিই আমাদের দেশের গাড়ি বাজারের সবচেয়ে রূঢ় বাস্তবতা।
আপনি কি জানেন?
বাংলাদেশে ৪০০০ সিসির ওপরের একটি গাড়ি আমদানি করতে হলে আপনাকে মূল দামের ওপর প্রায় ৮২৭% পর্যন্ত কর প্রদান করতে হতে পারে! এটি বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ গাড়ি করের হার।
২. গাড়ির ট্যাক্স ক্যালকুলেশন: একটি বাস্তব উদাহরণ
অনেকেই বুঝতে পারেন না গাড়ির ট্যাক্স ক্যালকুলেশন বাংলাদেশ ঠিক কীভাবে কাজ করে। এটি বেশ জটিল একটি প্রক্রিয়া, যেখানে ধাপে ধাপে কর যোগ হতে থাকে। ধরুন, আপনি জাপান থেকে একটি গাড়ি কিনলেন যার দাম ১০,০০০ ডলার। প্রথমে এই দামের সাথে শিপিং খরচ যোগ করে একটি 'অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু' তৈরি করা হয়। এরপর এর ওপর ২৫% কাস্টমস ডিউটি বসানো হয়। এরপর আসে সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি বা সম্পূরক শুল্ক, যা গাড়ির সিসির ওপর নির্ভর করে ৪৫% থেকে শুরু করে ৫০০% পর্যন্ত হতে পারে।
এখানেই শেষ নয়, এরপর ১৫% ভ্যাট বা যোগ হয়। ভ্যাটের পর আবার ৫% অগ্রিম আয়কর (AIT) দিতে হয়। সবশেষে আবার আছে অ্যাডভান্স ট্রেড ভ্যাট (ATV)। মজার ব্যাপার হলো, এই ট্যাক্সগুলো একটার ওপর আরেকটা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে। অর্থাৎ, কাস্টমস ডিউটি যোগ করার পর যে মূল্য হয়, তার ওপর ভ্যাট ধরা হয়। এভাবেই বাংলাদেশে গাড়ির দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায়। আমি নিচে একটি সাধারণ তালিকা দিচ্ছি যা দেখে আপনারা করের হার সম্পর্কে একটি ধারণা পাবেন।
গাড়ির সিসি ভেদে আনুমানিক মোট করের হার (Total Tax Incidence)
| ইঞ্জিন ক্ষমতা (CC) | মোট করের হার (আনুমানিক) | মন্তব্য |
|---|---|---|
| ০ - ১৬০০ সিসি | ১২৭% | সবচেয়ে জনপ্রিয় সেগমেন্ট (যেমন: টয়োটা এক্সিও, এলিয়ন) |
| ১৬০১ - ২০০০ সিসি | ২১৩% | মাঝারি মানের এসইউভি বা সেডান |
| ২০০১ - ৩০০০ সিসি | ৪০০% - ৫৫০% | প্রado বা হ্যারিয়ারের কিছু মডেল |
| ৩০০০ - ৪০০০ সিসি | ৬০০% + | লাক্সারি জিপ এবং স্পোর্টস কার |
৩. রিকন্ডিশন্ড বনাম নতুন গাড়ির দামের পার্থক্য
আমাদের দেশে রাস্তায় চলাচলকারী বেশিরভাগ গাড়িই রিকন্ডিশন্ড বা পুরাতন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির দাম কি আসলেই কম? সরকার রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ওপর ডেপ্রিসিয়েশন বা সুবিধা দেয়, যার ফলে নতুনের চেয়ে এর ওপর ট্যাক্স কিছুটা কম আসে। সাধারণত ১ থেকে ৫ বছরের পুরনো গাড়ি আমদানি করা যায় এবং বয়সের ওপর ভিত্তি করে ৩৫% থেকে ৪৫% পর্যন্ত অবচয় সুবিধা পাওয়া যায়। অর্থাৎ, গাড়ির মূল দাম কম দেখানো যায়, ফলে ট্যাক্সও কিছুটা কমে।
অন্যদিকে, নতুন গাড়ির দাম বাংলাদেশ সবসময়ই বেশি থাকে কারণ নতুন গাড়িতে কোনো সুবিধা পাওয়া যায় না। আপনাকে পুরো মূল্যের ওপরই ট্যাক্স দিতে হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ির দামও অনেক বেড়ে গেছে। জাপানে নিলামে গাড়ির দাম বৃদ্ধি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় রিকন্ডিশন্ড গাড়িও এখন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নতুনের চেয়ে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বাজার বড় হওয়ার মূল কারণ এই সামান্য ট্যাক্স সুবিধা, কিন্তু দিন দিন সেই ব্যবধানও কমে আসছে।

৪. ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও আমদানি খরচ
গত কয়েক বছরে আমদানি করা গাড়ির দাম বাংলাদেশ মার্কেটে বেড়ে যাওয়ার অন্যতম বড় কারণ হলো ডলারের উচ্চমূল্য। আমরা জানি যে বাংলাদেশ নিজেরা কোনো গাড়ি তৈরি করে না, সব গাড়িই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেন হয় ডলারে। কয়েক বছর আগেও যেখানে ১ ডলারের মূল্য ছিল ৮৫ টাকা, এখন তা বেড়ে ১১০ থেকে ১২০ টাকার ঘরে পৌঁছেছে। এই বিশাল পার্থক্যের কারণে আমদানিকারকদের গাড়ি কিনতেই এখন আগের চেয়ে ৩০-৪০% বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
যখন একজন আমদানিকারক বা ডিলার বেশি দামে ডলার কিনে এলসি (L/C) খোলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই বাড়তি খরচ তিনি গাড়ির বিক্রয়মূল্যের সাথে যোগ করেন। এ ছাড়া ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে অনেক সময় দেরি করছে বা নিরুৎসাহিত করছে। এর ফলে বাজারে গাড়ির সরবরাহ কমে যাচ্ছে। অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী, যখন চাহিদা থাকে কিন্তু সরবরাহ কমে যায়, তখন জিনিসের দাম বাড়ে। ঠিক এই কারণেই বাংলাদেশে গাড়ি কেনা ব্যয়বহুল কেন—তার উত্তর খুঁজতে গেলে ডলারের এই অস্থিরতাকে বাদ দেওয়া যাবে না।
অর্থনীতির পাঠ
ডলারের দাম ১ টাকা বাড়লে একটি ১৫০০ সিসির গাড়ির দাম ট্যাক্সসহ প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। গত ২ বছরে ডলারের দাম প্রায় ৩০ টাকা বেড়েছে, হিসাবটি কষে দেখুন!
৫. সিসি (Engine CC) ভেদে করের তারতম্য
বাংলাদেশে গাড়ির ট্যাক্স নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইঞ্জিনের ক্ষমতা বা সিসি (CC) একটি বিশাল ভূমিকা পালন করে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, ১৫০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির ট্যাক্স তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু আপনি যদি ১৬০০ সিসি বা তার বেশি ক্ষমতার গাড়ি পছন্দ করেন, তবে আপনাকে বিশাল অংকের সম্পূরক শুল্ক দিতে হবে। এই নীতিটি অনেক ক্রেতার জন্যই হতাশাজনক। কারণ, আধুনিক প্রযুক্তির অনেক ভালো গাড়িই এখন ১৫০০ সিসির ওপরে হয়ে থাকে।
সরকারের এই নীতির কারণে আমদানিকারকরাও বাধ্য হয়ে শুধুমাত্র ১৫০০ সিসির নিচের গাড়িগুলোই বেশি আমদানি করেন। এতে করে বাজারে বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। যেমন, টয়োটা করোলা বা এক্সিও এত জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলো এগুলোর ইঞ্জিন ১৫০০ সিসির মধ্যে। আপনি যদি একটু বেশি ক্ষমতার ইঞ্জিন চান, তবে আপনাকে প্রায় দ্বিগুণ ট্যাক্স দিতে হবে, যা গাড়ির দাম বেশি বাংলাদেশ হওয়ার একটি প্রধান কারণ। এটি এক ধরণের কৃত্রিম ব্যারিয়ার তৈরি করে রেখেছে।
৬. অবকাঠামো ও রেজিস্ট্রেশন খরচের প্রভাব
গাড়ি কেনার পরেও কিন্তু খরচের হাত থেকে রেহাই নেই। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন খরচ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (BRTA) কর্তৃক নির্ধারিত হয় এবং এটিও বেশ ব্যয়বহুল। একটি নতুন বা রিকন্ডিশন্ড গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করতে আপনাকে রেজিস্ট্রেশন ফি, ফিটনেস ফি, ট্যাক্স টোকেন এবং ডিজিটাল নম্বর প্লেটের জন্য টাকা দিতে হয়। বিশেষ করে ১৫০০ সিসির ওপরের গাড়ির জন্য প্রতি বছর বিশাল অংকের আয়কর বা অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয় ট্যাক্স টোকেন নবায়নের সময়।
এছাড়া, ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকদের জন্য এখন কার্বন ট্যাক্স বা পরিবেশ সারচার্জও যুক্ত হয়েছে যদি আপনার একাধিক গাড়ি থাকে। এই সব মিলিয়ে গাড়ি রাস্তায় নামাতেই এবং প্রতি বছর মেইনটেইন করতেই পকেট ফাঁকা হয়ে যায়। আমি দেখেছি, অনেকে কষ্ট করে গাড়ি কেনেন ঠিকই, কিন্তু প্রতি বছরের এই রেজিস্ট্রেশন ও ট্যাক্স নবায়ন খরচ মেটাতে গিয়ে হিমশিম খান। তাই শুধু গাড়ির দাম নয়, আনুষাঙ্গিক এই সরকারি ফি-গুলোও বাংলাদেশে গাড়ির দাম এবং মালিকানা খরচ বাড়িয়ে দেয়।

৭. ডিলারদের মুনাফা ও শোরুমের খরচ
আমরা সব সময় সরকারকে দোষারোপ করি, কিন্তু ডিলার বা ব্যবসায়ীদের দিকটাও দেখা দরকার। গুলশান বা বারিধারার মতো এলাকায় একটি বড় শোরুম ভাড়া নেওয়া, কর্মচারীদের বেতন দেওয়া এবং ব্যাংকের চড়া সুদের ঋণ পরিশোধ করা—সব কিছুই কিন্তু গাড়ির দামের সাথে যুক্ত হয়। যেহেতু গাড়ি একটি হাই-ভ্যালু প্রোডাক্ট, তাই এটি স্টকে বা শোরুমে দীর্ঘদিন পড়ে থাকলে ব্যবসায়ীর বিশাল অংকের টাকা আটকে থাকে।
এই ঝুঁকি বা 'কস্ট অফ ফান্ড' সামলাতে ডিলাররা প্রতি গাড়িতে একটি মোটা অংকের লাভ বা মার্জিন রাখেন। অনেক সময় দেখা যায়, সিন্ডিকেটের মাধ্যমেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানো হয়। তবে বর্তমানে প্রতিযোগিতার বাজারে অত্যধিক লাভ করার সুযোগ কমেছে। তবুও, শোরুমের চাকচিক্য এবং সার্ভিস ওয়ারেন্টি নিশ্চিত করতে গিয়ে যে খরচ হয়, তা শেষ পর্যন্ত ক্রেতার পকেট থেকেই যায়। এই বাণিজ্যিক খরচগুলোও বাংলাদেশে গাড়ির দাম বেশি কেন তার একটি বাস্তবিক কারণ।
৮. স্থানীয় উৎপাদনের অভাব
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আমরা নিজেরা কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ গাড়ি তৈরির কারখানা গড়ে তুলতে পারিনি। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত টাটা বা মাহিন্দ্রার মতো ব্র্যান্ড তৈরি করেছে, আর আমরা এখনো পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ সরকারিভাবে কিছু গাড়ি সংযোজন (Assembling) করে ঠিকই, কিন্তু তা চাহিদার তুলনায় খুবই নগণ্য এবং প্রযুক্তিতেও পিছিয়ে।
যদি দেশে গাড়ি তৈরি হতো বা বড় বড় কোম্পানিগুলো এখানে ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট বসাতো, তবে আমদানির ওপর নির্ভরতা কমত এবং বিশাল অংকের শুল্ক বেঁচে যেত। স্থানীয় উৎপাদন না থাকায় আমাদের সম্পূর্ণভাবে বিদেশি বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয়। আর বিদেশ থেকে কিছু আনা মানেই শিপিং কস্ট, ইন্স্যুরেন্স এবং পোর্টের ঝামেলা। এই স্ট্রাকচারাল বা কাঠামোগত দুর্বলতাই বাংলাদেশে গাড়ির দাম কমার পথে সবচেয়ে বড় বাধা।
অন্য দেশের চিত্র
ভারতে 'মেক ইন ইন্ডিয়া' উদ্যোগের কারণে সেখানে গাড়ির দাম বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় অর্ধেক বা তারও কম। কারণ তারা দেশেই গাড়ি উৎপাদন করে, ফলে আমদানি শুল্ক লাগে না।
৯. ভারত ও প্রতিবেশী দেশের সাথে তুলনা
আমি যখন ভারতের কোনো গাড়ির ওয়েবসাইটের সাথে বাংলাদেশের দাম তুলনা করি, তখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। মারুতি সুজুকির যে গাড়িটি ভারতে ৫-৬ লাখ রুপি (যা বাংলাদেশি টাকায় ৮-৯ লাখ টাকা), সেই একই ক্যাটাগরির গাড়ি বাংলাদেশে কিনতে ২০ লাখ টাকার বেশি লাগে। এই বিশাল পার্থক্যের মূল কারণ দুটি: স্থানীয় উৎপাদন এবং শুল্ক নীতি। ভারতে নিজস্ব অটোমোবাইল শিল্প থাকায় সেখানে সরকারকে সুরক্ষামূলক উচ্চ শুল্ক আরোপ করতে হয় না।
অন্যদিকে, পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কাতেও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গাড়ির দাম বেড়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের মতো এত চড়া শুল্ক কাঠামো খুব কম দেশেই আছে। আমাদের দেশে গাড়িকে এখনো 'বড়লোকদের খেলনা' হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু বর্তমান যুগে এটি যে মধ্যবিত্তের যাতায়াতের একটি নিরাপদ মাধ্যম, সেই দৃষ্টিভঙ্গি নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এখনো পুরোপুরি আসেনি। তাই প্রতিবেশীদের তুলনায় আমাদের দেশে গাড়ি কেনা অনেক বেশি কঠিন এবং ব্যয়বহুল।
১০. হাইব্রিড ও ইলেকট্রিক গাড়ির বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ইলেকট্রিক গাড়ির (EV) জয়জয়কার চলছে। বাংলাদেশেও সরকার পরিবেশ দূষণ কমাতে হাইব্রিড ও ইলেকট্রিক গাড়ির ওপর কিছুটা শুল্ক ছাড় দিয়েছে। হাইব্রিড গাড়ির সিসি বেশি হলেও সাধারণ ফুয়েল গাড়ির তুলনায় এতে ট্যাক্স কিছুটা কম। এই কারণে এখন রাস্তায় প্রচুর টয়োটা অ্যাকুয়া বা প্রিয়াস বা হোন্ডা গ্রেস দেখা যাচ্ছে। এগুলো জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব।
তবে, ইলেকট্রিক গাড়ির জন্য চার্জিং স্টেশনের অভাব এবং ব্যাটারি রিপ্লেসমেন্ট নিয়ে মানুষের মনে ভীতি কাজ করে। যদিও সরকার ইভি (EV) আমদানিতে উৎসাহ দিচ্ছে, তবুও এর প্রাথমিক দাম এখনো সাধারণের নাগালের বাইরে। তবুও, যদি আপনি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেন এবং জ্বালানি খরচ কমাতে চান, তবে হাইব্রিড গাড়ি একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। এটি হয়তো বাংলাদেশে গাড়ি কেনা ব্যয়বহুল কেন—এই প্রশ্নের পুরোপুরি সমাধান দেবে না, কিন্তু রানিং কস্ট কমাতে সাহায্য করবে।

১১. গাড়ি কেনার আগে কিছু জরুরি পরামর্শ
এত সব সমস্যার পরেও যদি আপনি গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নেন, তবে আমার কিছু পরামর্শ আপনার কাজে আসতে পারে। প্রথমত, বাজেট নির্ধারণের সময় শুধু গাড়ির দাম নয়, রেজিস্ট্রেশন, ইন্স্যুরেন্স এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচও মাথায় রাখুন। ১৫০০ সিসির নিচে গাড়ি কিনলে ট্যাক্স কম দিতে হবে, তাই প্রথম গাড়ি সেরা পছন্দ। রিকন্ডিশন্ড গাড়ি কেনার সময় অবশ্যই অকশন শিট (Auction Sheet) যাচাই করে নেবেন।
দ্বিতীয়ত, ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি কিনলে অফিসিয়াল ডিলার থেকে কেনাই ভালো, এতে ওয়ারেন্টি এবং সার্ভিস নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। আর যদি বাজেট কম থাকে, তবে সেকেন্ড হ্যান্ড বা 'ইউজড কার' মার্কেট দেখতে পারেন। সেখানে অনেক সময় ভালো কন্ডিশনের গাড়ি কম দামে পাওয়া যায়। মনে রাখবেন, গাড়ি কেনা একটি আবেগের বিষয় হলেও, সিদ্ধান্তটি হতে হবে সম্পূর্ণ গাণিতিক ও বাস্তবসম্মত।

টিপস
কখনোই অকশন শিট ভেরিফাই না করে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি কিনবেন না। অনেক সময় মাইলেজ কমিয়ে বা দুর্ঘটনার তথ্য গোপন করে গাড়ি বিক্রি করা হয়।
সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)
বাংলাদেশে গাড়ির ট্যাক্সের পরিমাণ ইঞ্জিনের সিসি (CC) এবং গাড়ির প্রকারভেদের ওপর নির্ভর করে। সাধারণত ১৫০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির জন্য মোট করের হার (Total Tax Incidence) প্রায় ১২৭%। এর অর্থ হলো, ১০০ টাকার গাড়িতে আপনাকে আরও ১২৭ টাকা কর দিতে হবে। ১৬০০ সিসি থেকে ২০০০ সিসি পর্যন্ত এটি প্রায় ২১৩% এ গিয়ে দাঁড়ায়। আর বিলাসবহুল বা ৪০০০ সিসির ওপরের গাড়ির ক্ষেত্রে এই কর ৮০০% এর বেশিও হতে পারে। এই করের মধ্যে কাস্টমস ডিউটি, ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক এবং অন্যান্য ফি অন্তর্ভুক্ত থাকে।
হ্যাঁ, সাধারণত বাংলাদেশে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি নতুন বা ব্র্যান্ড নিউ গাড়ির চেয়ে সস্তা হয়। এর মূল কারণ হলো 'অবচয় সুবিধা' বা Depreciation Benefit। সরকার ৫ বছর পর্যন্ত পুরনো গাড়ি আমদানির অনুমতি দেয় এবং গাড়ির বয়সের ওপর ভিত্তি করে ৩৫% থেকে ৪৫% পর্যন্ত অবচয় সুবিধা পাওয়া যায়। অর্থাৎ, গাড়ির যে মূল্যের ওপর ট্যাক্স ধরা হবে, তা নতুনের চেয়ে কম দেখানো হয়। ফলে মোট শুল্ক কিছুটা কমে আসে। তবে বর্তমানে জাপানে গাড়ির দাম বাড়ার কারণে এই ব্যবধান কমে আসছে।
হাইব্রিড গাড়ির মূল প্রযুক্তি বা বেস প্রাইস সাধারণ পেট্রোল গাড়ির চেয়ে বেশি হলেও, বাংলাদেশে হাইব্রিড গাড়ির ওপর শুল্ক হার কিছুটা কম। সরকার পরিবেশবান্ধব গাড়িকে উৎসাহিত করার জন্য এই ছাড় দিয়েছে। বিশেষ করে ১৮০০ সিসি পর্যন্ত হাইব্রিড গাড়ির ক্ষেত্রে শুল্ক সুবিধা পাওয়া যায়। তাই অনেক সময় দেখা যায়, সমান সিসির একটি সাধারণ পেট্রোল গাড়ির চেয়ে হাইব্রিড গাড়ির দাম কিছুটা কম। এ ছাড়া হাইব্রিড গাড়ির জ্বালানি খরচ অনেক কম হওয়ায় এটি সাশ্রয়ী।
বাংলাদেশে বর্তমানে পূর্ণাঙ্গভাবে গাড়ি তৈরি বা ম্যানুফ্যাকচারিং হয় না। আমাদের দেশে যা হয় তা হলো 'অ্যাসেম্বলিং' বা সংযোজন। সরকারি প্রতিষ্ঠান 'প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ' মিতসুবিশি এবং অন্যান্য কিছু ব্র্যান্ডের গাড়ি সংযোজন করে। এছাড়া পিএইচপি অটোমোবাইলস মালয়েশিয়ার প্রোটন ব্র্যান্ডের গাড়ি দেশে সংযোজন করছে এবং হুন্দাই তাদের কারখানা স্থাপন করেছে। তবে এগুলোকে পুরোপুরি 'মেইড ইন বাংলাদেশ' বলা কঠিন কারণ এর প্রধান যন্ত্রাংশগুলো বিদেশ থেকেই আমদানি করতে হয়। স্থানীয় উৎপাদন শুরু হলে দাম অনেক কমবে বলে আশা করা যায়।
গাড়ির রেজিস্ট্রেশন খরচ নির্ভর করে গাড়ির সিসি বা ইঞ্জিন ক্ষমতার ওপর। ১৫০০ সিসি পর্যন্ত একটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ফি, ডিজিটাল ব্লু-বুক, নম্বর প্লেট এবং রোড ট্যাক্স মিলিয়ে প্রাথমিক খরচ প্রায় ১ লক্ষ ৩৫ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার মতো হতে পারে (এর মধ্যে অগ্রিম আয়কর অন্তর্ভুক্ত)। সিসি বাড়লে এই খরচ বাড়ে। বিশেষ করে ফিটনেস নবায়ন এবং ট্যাক্স টোকেনের জন্য প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট ফি দিতে হয়। বর্তমানে ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য কার্বন ট্যাক্সও প্রযোজ্য হতে পারে যদি আপনার একাধিক গাড়ি থাকে।
মূল কথা (Key Takeaways)
- উচ্চ শুল্ক: বাংলাদেশে গাড়ির দাম বেশি হওয়ার প্রধান কারণ ১২৭% থেকে ৮০০% পর্যন্ত উচ্চ আমদানি শুল্ক।
- ডলার সংকট: ডলারের মূল্যবৃদ্ধি আমদানিকারকদের খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে, যা ক্রেতার ওপর চাপছে।
- সিসি লিমিট: ১৫০০ সিসির ওপরের গাড়িতে ট্যাক্স প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
- অবচয় সুবিধা: রিকন্ডিশন্ড গাড়িতে অবচয় সুবিধা থাকায় তা নতুনের চেয়ে কিছুটা সস্তা।
- উৎপাদন নেই: দেশে নিজস্ব গাড়ি তৈরির কারখানা না থাকায় আমরা আমদানিনির্ভর।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে গাড়ির দাম বেশি কেন—এর উত্তর এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। এটি উচ্চ শুল্ক নীতি, আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং স্থানীয় উৎপাদনের অভাবের একটি সম্মিলিত ফল। যতদিন না আমাদের দেশে নিজস্ব অটোমোবাইল শিল্প গড়ে উঠবে এবং নীতিমালায় বড় ধরণের পরিবর্তন আসবে, ততদিন হয়তো আমাদের এই চড়া দামেই গাড়ি কিনতে হবে।
তবে আশার কথা হলো, হাইব্রিড ও ইলেকট্রিক গাড়ির প্রতি সরকারের ইতিবাচক মনোভাব এবং কিছু বেসরকারি কোম্পানির সংযোজন কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ ভবিষ্যতে গাড়ির বাজারকে কিছুটা হলেও স্থিতিশীল করতে পারে। গাড়ি কেনা যদি আপনার স্বপ্ন হয়, তবে সঠিক তথ্য জেনে এবং বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। CarSell.com.bd এর সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
আপনার স্বপ্নের গাড়িটি খুঁজছেন?
সেরা দামে এবং সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে রিকন্ডিশন্ড বা নতুন গাড়ি কিনতে ভিজিট করুন আমাদের ওয়েবসাইট।
গাড়ি দেখুন এখানে